কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। জিডিপির একটি বড় অংশ আসে কৃষি থেকে, আর দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকা এর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রায়শই প্রশ্ন ওঠে: বাংলাদেশের কৃষি কি লাভজনক, নাকি লোকসানে চলছে? এবং এর সাথে জড়িত কৃষকের ভবিষ্যৎ কোন পথে? এই ব্লগ পোস্টে আমরা এই জটিল প্রশ্নের গভীরে যাবো।
বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান চিত্র: লাভ-লোকসানের দোলাচল
বাংলাদেশের কৃষি একদিকে যেমন দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, তেমনি অন্যদিকে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। তবে, লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লাই কখনও কখনও ভারী হয়, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য।
লাভের দিকগুলো:
খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি: বাংলাদেশ ধান, মাছ, সবজি উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। এতে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত উৎপাদনও হচ্ছে।
রপ্তানি সম্ভাবনা: কিছু কৃষি পণ্য, যেমন - সবজি, আলু, মসলা, ও পাট বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করছে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি: কৃষি খাত দেশের বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত।
লোকসানের কারণগুলো:
প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি—এগুলো কৃষকদের ফসল নষ্ট করে দেয় এবং বিশাল আর্থিক ক্ষতি সাধন করে।
পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া: মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণের অভাবে কৃষকরা প্রায়শই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না।
উচ্চ উৎপাদন খরচ: সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, যা কৃষকের মুনাফা কমিয়ে দিচ্ছে।
ঋণ ও সুদের বোঝা: অনেক কৃষককেই মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয়, যা তাদের আর্থিক বোঝা আরও বাড়িয়ে তোলে।
আধুনিক প্রযুক্তির অভাব: আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, উন্নত বীজ এবং উন্নত সেচ ব্যবস্থার অপ্রাপ্যতা অনেক সময় ফলন কমিয়ে দেয়।
ভূমিকম্পনের ঝুঁকি: যদিও বাংলাদেশে বড় আকারের ভূমিকম্প বিরল, তবে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় কৃষির ওপর এর পরোক্ষ প্রভাব পড়তে পারে (যেমন: অবকাঠামোগত ক্ষতি, ভূমিধস ইত্যাদি)।
কৃষকের ভবিষ্যৎ কোন পথে?
কৃষকের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এবং কৃষিকে লাভজনক করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি:
আধুনিকীকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার: উন্নত জাতের বীজ, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি কৃষকদের উৎপাদন বাড়াতে এবং খরচ কমাতে সাহায্য করবে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিত কৃষকদের এই বিষয়ে সহায়তা করা।
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কেনার ব্যবস্থা করা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো, এবং সরকারি ক্রয় কেন্দ্রগুলোতে কৃষকদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। হিমাগার স্থাপন ও উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থা কৃষকদের লোকসান কমাতে সাহায্য করবে।
সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা: কৃষকদের কাছে সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা মহাজনদের ওপর নির্ভরশীল না হন।
কৃষি বীমা চালু: প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় কৃষি বীমা চালু করা কৃষকদের জন্য একটি বড় রক্ষাকবচ হতে পারে।
কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ: কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে পণ্যের মূল্য সংযোজন করা গেলে কৃষক লাভবান হবেন এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
গবেষণা ও উন্নয়ন: জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ফসল উদ্ভাবন এবং নতুন কৃষি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন বাড়ানো প্রয়োজন।
উপসংহার
বাংলাদেশের কৃষি লাভ-লোকসানের এক জটিল সমীকরণে আটকে আছে। তবে সঠিক পরিকল্পনা, নীতি সহায়তা, এবং কৃষকদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষিকে একটি টেকসই ও লাভজনক খাতে পরিণত করা সম্ভব। এতে কেবল কৃষকদের জীবনমানের উন্নয়ন হবে না, বরং দেশের overall অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে। কৃষকের ভবিষ্যৎ যদি নিশ্চিত হয়, তবেই বাংলাদেশের উন্নয়ন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে।