গমের বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার


May 30, 2023
কৃষি সম্পর্কিত
গমের বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার

গমের বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার


১।রোগের নামঃ

গমের গোড়া পচা রোগ Foot Rot of Wheat (Sclerotium rolfsii)

লক্ষণঃ

  • এ রোগের ফলে বীজে পচন ধরে ধরে। চারা ঝলসে যায় এবং গোড়া ও শিকড় পচে যায়।

  • চারা অবস্থায় আক্রান্ত হলে প্রথমে কান্ডের নীচের দিকের পাতা হলুদ হয়ে আসে পরে ক্রমশ উপরের দিকের পাতায়ও ছড়িয়ে পড়ে।

  • গাছটি হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং আস্তে আস্তে মারা যায়। এ অবস্থায় গাছটি টান দিলে সহজেই মাটি হতে উঠে আসে।

  • আক্রান্ত গাছটির গোড়া ভালোভাবে পরীক্ষা করলে এতে সাদা বর্ণের তুলার মত ছত্রাকের মাইসেলিয়াম এবং কখনও সরিষার দানার মত স্কেলেরোসিয়া দেখা যায়।

  • শিকড় ও কাণ্ড – সংলগ্ন অংশে লালচে বাদামী দাগ দেখতে পাওয়া যায়।

সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনাঃ

  • চারা লাগানোর ৫-৭ দিন আগে ট্রাইকো-কম্পোস্ট মাটিতে ভালভাবে মিশিয়ে এ রোগ দমন করা যায়।

২।রোগের নামঃ

গমের বীজের কাল দাগ রোগ Black Point of Wheat (Bipolaris sorokiniana or Alternaria spp.)

লক্ষণঃ

  • এ রোগের কারণে গম বীজের উপরিভাগে বিভিন্ন আকারের বাদামী অথবা কালো দাগ পড়ে।

  • বীজের ভ্রণাংশেও বাদামী থেকে কালচে বাদামী রঙের দাগ পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে দাগ সম্পূর্ণ বীজে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ভ্রুণ আক্রান্ত হয় এবং অংকুরোদগম ক্ষমতা কমে যায়।

  • গমের দানা গঠনের সময় বা কর্তনের কয়েকদিন আগে বাতাসের অধিক আর্দ্রতা এবং উচ্চ তাপমাত্রা এ রোগ বিস্তারের জন্য সহায়ক।

  • কাল দাগ পড়ায় বাজারে বীজের মূল্যও হ্রাস পায়।

সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনাঃ

  • উপযুক্ত সময়ে (১৫-৩০ নভেম্বর) বীজ বপন করা।

  • পাকার পরে দেরী না করে বৃষ্টির আগেই ফসল কর্তন করা।

  • প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি (৩ গ্রাম/কেজি) দ্বারা বীজ শোধন করা।

  • টিল্ট ২৫০ ইসি অথবা ফলিকুর ২৫০ ইসি নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হিসাবে মিশিয়ে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং এর দুই সপ্তাহ পর আর একবার গাছে প্রয়োগ করা।

৩।রোগের নামঃ

গমের ব্লাস্ট রোগ Blast of Wheat (Magnaporthe oryzae pathotype triticum)

লক্ষণঃ 

  • এ রোগের জীবাণু গাছের উপরের সব অংশে আক্রমণ করতে পারে। তবে গমের শীষে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

  • প্রাথমিকভাবে গম ক্ষেতে প্যাঁচ আকারে শীষ সাদা হওয়া দেখা যায়, অনুকূল আবহাওয়ায় অতি দ্রুত তা সারা ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে।

  • গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে বৃষ্টিপাত হলে এবং এর পরপরেই তুলনামূলক গরম ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া বিরাজমান থাকলে এ রোগের আক্রমণ ঘটতে পারে।

  • শীষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে, আক্রান্ত স্থানের উপরের অংশ সাদা হয়ে যায় এবং শীষের গোড়ায় আক্রমণ হলে পুরো শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়।

  • আক্রান্ত শীষের দানা অপুষ্ট হয় ও কুঁচকে যায় এবং দানা ধূসর বর্ণের হয়ে যায় ।

  • পাতায়ও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে তবে এক্ষেত্রে পাতায় চোখের ন্যায় ধূসর বর্ণের ছোট ছোট পানি ভেজা দাগ পড়ে।

সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনাঃ

  • ব্লাস্টমুক্ত ক্ষেত থেকে গম বীজ সংগ্রহ করা।

  • উপযুক্ত সময়ে (১৫-৩০ নভেম্বর) বীজ বপন করা যাতে শীষ বের হওয়ার সময়ে বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা পরিহার করা যায়।

  • অপেক্ষাকৃত কম সংবেদনশীল জাত যেমন-বারি গম-৩০ ও বারি গম-৩৩ জাতের চাষ করা।

  • গমের ক্ষেত ও আইল আগাছামুক্ত রাখা।

  • প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি (৩ গ্রাম/কেজি) দ্বারা বীজ শোধন করা।

  • ছত্রাকনাশক নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি ৬ গ্রাম অথবা ফলিকুর ২৫০ ইসি ১০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং তার ১২-১৫ দিন পর পর আরেকবার স্প্রে করা।

৪।রোগের নামঃ

গমের ঝুল রোগ Loose Smut of Wheat (Ustilago tritici)

লক্ষণঃ

  • গমের শীষে এ রাগ দেখা যায়।

  • আক্রান্ত শীষের গায়ে অসংখ্য পাউডারের মতো কালো গুঁড়া দেখা যায়।

  • আক্রমন তীব্র হলে শীষ থেকে গমগুলো ঝরে পড়ে এবং শীষ দানাশুন্য যায়।

  • বাতাসের সাহায্যে এ রোগ ছড়ায়।

সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনাঃ

  • রোগমুক্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করা।

  • আক্রান্ত শীষ দেখা মাত্র সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলা।

  • বীজ বপনের পূর্বে বীজ শোধন করা যথা ৩ গ্রাম প্রোভেক্স বা ভিটাটেক্স বা ২ গ্রাম ব্যাভিষ্টিন/ কেজি বীজ।

  • ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা। যেমন ব্যাভিষ্টিন- ১ গ্রাম/ লিটার পানি।

৫।রোগের নামঃ

গমের পাতার মরিচা রোগ Leaf Rust of Wheat (Puccinaia graminis tritici)

লক্ষণঃ

  • গমের কান্ড, পাতা ও পর্বসন্ধিতে এ রোগ দেখা যায়।

  • রোগের আক্রমণে লোহার মরিচার মতো লালচে রঙের দাগ পড়ে।

  • দাগগুলো পরে কালো রঙ হয়।

সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনাঃ

  • আক্রান্ত ক্ষেতের নাড়া পুড়িয়ে ফেলা।

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত ব্যবহার করা।

  • সুষম সার ব্যবহার করা।

  • বীজ বপনের পূর্বে বীজ শোধন করা যথা ৩ গ্রাম প্রোভেক্স বা ভিটাটেক্স বা ২ গ্রাম ব্যাভিষ্টিন/ কেজি বীজ।

  • অনুমোদিত বালাইনাশক ব্যবহার করা যথা টিল্ট ২৫০ ইসি ১ মিলি বা ক্যাালিক্সিন ০.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।

৬।রোগের নামঃ

গমের পাতা ঝলসানো রোগ Leaf Blight Disease of Wheat (Bipolaris sorokininana)

লক্ষণঃ

  • পাতায় বাদামী ফুসকুরী আকারে দাগ দেখা যায়।

  • পরে এসব দাগগুলো একমেত্র মিশে যায় এবং সম্পূর্ণ পাতা পোড়া দেখায়।

  • আক্রমণ বেশী হলে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন কমে যেতে পারে।

সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনাঃ

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত ব্যবহার করা।

  • বীজ বপনের পূর্বে প্রোভেক্স বা বিটাভেক্স ২০০ (১০০ গ্রাম/কেজি বীজ) দ্বারা শোধন করা।

  • আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যথা প্রোপিকোনাজল (টিল্ট ২৫০ ইসি) ১ মিঃ লিঃ প্রতি লিটার পানিতে।

                                                                    (তথ্যসূত্রে- plant disease clinic BAU)


ইঁদুর দমন: 

ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ শুরু হলে ফাঁদ পেতে, গর্তে পানি ঢেলে বা বিষটোপ (জিংক ফসপাইড/লানির্যাট) দিয়ে ইঁদুর দমন করতে হবে।

গমের ইঁদুর দমনে বিষ টোপের ব্যবহার:

ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ শুরু হলে ফাঁদ পেতে বা বিষটোপ (জিঙ্ক ফসফাইড বা ল্যানিরেট) দিয়ে দমন করতে হবে। গম পাকার সময় ইঁদুর সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করে । বিএআরআই উদ্ভাবিত ২% জিঙ্ক সালফাইড বিষ টোপ ইঁদুর দমনে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।  ১ কেজি পরিমাণ বিষটোপ তৈরির উপাদান-

উপাদান

পরিমাণ ( গ্রাম )

গম

৯৬৫

বার্লি

১০

জিঙ্ক ফসফাইড (সক্রিয় উপাদান ৮০%)

২৫

পানি

১০০

এলুমিনিয়ামের পাত্রে ১০ গ্রাম বার্লি ও ১০০ এমএল পানি মিশিয়ে ২-৩ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। বার্লি আঠালো হয়ে গেলে পাত্রটি নামিয়ে ফেলতে হবে। ঠান্ডা হওয়ার পর ২৫ গ্রাম  জিঙ্ক ফসফাইড আঠালো বার্লির সাথে ভালোভাবে মেশাতে হবে। জিঙ্ক ফসফাইড মেশানোর পর ৯৬৫ গ্রাম গমের দানা পাত্রে ঢেলে এমন ভাবে মেশাতে হবে যেন প্রতিটি গমের দানার গায়ে কালো আবরণ পড়ে। এরপর গম দানা এক ঘন্টা রোদে শুকালে তা বিষটোপে পরিণত হবে। পরে তা ঠান্ডা করে পলিথিন ব্যাগ বা বায়ুরোধক পাত্রে রাখতে হবে।

ব্যবহারের নিয়মঃ

গমের জমিতে সদ্য মাটি উঠানো গর্ত সনাক্ত করতে হবে। ৩-৫ গ্রাম জিঙ্ক ফসফাইড বিষটোপ কাগজে রেখে শক্ত করে পুটলি বাঁধতে হবে। গর্তের মুখের মাটি সরিয়ে এ পুটলি ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে অথবা সতেজ গর্তের আশে পাশে কাগজে বা মাটির  পাত্রে বিষটোপ রেখে দিতে হবে। বিষটোপ খেলে  ইঁদুর সাথে সাথে মারা যাবে।

পোকা মাকড়:

১।গমের গোলাপী মাজরা পোকা: পোকার ইংরেজি নাম: Wheat Pink Stem Borer (Sesamia inferens); Order: Lepidoptera

এই পোকার লক্ষণ: এরা কাণ্ডের ভেরে প্রবেশ করে মাঝের পাতা ও শীষের গোড়া কেটে দেয়। ফলে গম গাছ শেষতক মারা যায়।

প্রতিকার:

(১) ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থাকরণ;

(২) ডিমের গাঁদা নষ্ট করে ফেলা;

(৩) নাড়া পুড়িয়ে ফেলা;

(৪) আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত বালাইনাশক ব্যবহার করা; যেমন হেক্টর প্রতি ১০ কেজি কর্বোফুরান৫ জি বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি ১.৬০ লিটার হারে

২।গমের জাব পোকা(Wheat Aphid: Rhopalosiphum rufiabdominalis):

 লক্ষণ: পাতা, কাণ্ড ও শীষের কচিদানা শুষে খেয়ে গাছ দুর্বল করে ফেলে

প্রতিকার:

(১) পরভোজী পোকার বংশ বৃদ্ধি করা যেমন লেডি বার্ড বিটল

 (২) আক্রমণ বেশি হলে: প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি ইমিডাক্লোরোপিড বা এসিফেট(১ গ্রাম) স্প্রে করা যেতে পারে।

 

উঁইপোকা(Termite: Microtermes anandi):

লক্ষণ: (১) চারা অবস্থায় আক্রমণ করলে চারা বাড়ে না।

প্রতিকার: (১) প্লাবন সেচ দেয়া;

 (২) আক্রমণ বেশি হলে ক্লোরোপাইরিফস (প্রতি একরে ৪.৫ লিটার)স্পে করা

 



Recent Posts

ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইট(BLB)

Apr 17, 2024
ফসলের রোগ-বালাই