গম চাষের জন্য জমি তৈরি , সার প্রয়োগ ও পানি ব্যবস্থাপনা
মাটির প্রকৃতিঃ
উঁচু ও মাঝারি দো-আঁশ মাটি গম চাষের জন্য বেশি উপযোগী ৷ লোনা মাটিতে গমের ফলন কম হয় ৷ সাধারণত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি গম চাষের জন্য উপযুক্ত ৷ তবে মাঝারি নিচু জমিতেও গম চাষ হয় ৷ দোঁআশ ও বেলে-দোঁআশ মাটি গম চাষের জন্য সর্বোত্তম ৷ সহজে পানি নিষ্কাশিত হয় এমন ভারী অর্থাৎ এঁটেল ও এঁটেল-দোঁআশ মাটিতেও গমের চাষ করা যায় ৷
উপযুক্ত জলবায়ু :
গ্রীষ্ম ও অবগ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু হতে শুরু করে নাতিশীতোষ্ঞ ও তুন্দ্রাঞ্চলীয় জলবায়ুতেও গম জন্মে৷ বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫-৪৫ ইঞ্চি অর্থাত্ ৩৮০-১১৪৩ মিলিমিটার গম চাষের জন্য খুব উপযোগী, তবে ১০-৭০ ইঞ্চি অর্থাত্ ২৫৪-১৭৭৮ মিলিমিটার পর্যন্ত বার্ষিক গড়পড়তা বৃষ্টিতেও গম ভালো জণ্মে৷ একদিকে সাইবেরিয়া ও মেরু অঞ্চলের প্রবল শৈত্যেও গম গাছ টিকে থাকতে পারে, অন্যদিকে ২১-২৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়ও গম চাষ করা যায়৷ তবে গরম আবহাওয়ায় ফুল ফুটার সময় ঠান্ডা পরিবেশ বর্তমান থাকা প্রয়োজনীয়, অন্যথায় গম গাছে দানার উত্পত্তি হয় না৷ ভূমির উচ্চতার দিক হতেও গম অদ্ভুত রকমে খাপ খাওয়াতে পারে৷ সমুদ্র সমতল হতে ১০,০০০ ফুট অর্থাত্ ৩১০০ মিটার উচ্চতায়ও গম জন্মাতে দেখা যায়৷
বপনের সময়ঃ
গমের উচ্চ ফলনশীল জাতসমূহের বপনের উপযুক্ত সময় হল কার্তিক মাসের শেষ থেকে অগ্রহায়ণর তৃতীয় সপ্তাহ (নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত)। যে সব এলাকায় ধান কাটতে ও জমি তৈরী করতে বিলম্ব হয় সে ক্ষেত্রে কাঞ্চন,আকবর, অঘ্রাণী, প্রতিভা ও গৌরব বপন করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
জমি তৈরি পদ্ধতি
জমিতে ৪-৬টি চাষ মই দিয়ে তৈরি করতে হবে৷ চাষ কম হলে গম বীজের অঙ্কুরোদগমে বিঘ্ন ঘটে৷ মাটির জো অবস্থায় জমি চাষ দিতে হবে৷ এতে মাটিতে ঢেলা থাকবে না, মাটি সমতল হবে৷ জমি চাষ করর সময় আগাছা ভালোভাবে বাছাই করতে হবে, যাতে ফসলে আগাছার প্রকোপ কম হয়৷ গমের জমির চাষ ১০-১২ সেন্টিমিটার গভীরে হওয়া দরকার৷ পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ দিলে ২-৩টি চাষই যথেষ্ট, তবে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমি সমতল করতে হবে৷
বীজ বপনের পূর্বে করনীয়ঃ
বীজ শোধনঃ
প্রোভেক্স/ভিটাভেক্স ২০০ প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধনের ফলে চারা সবল ও সতেজ হয় এবং গম গজানোর হার ও ফলন বৃদ্ধি পায়। বীজ শোধন করলে শতকরা ১০-১২ কেজি বৃদ্ধি পায়।
বীজের হারঃ
হেক্টর প্রতি ১২০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। বীজ গজানোর ক্ষমতা ৮০% এর বেশী হলে ভালো হয়।
বপনের পদ্ধতিঃ
সারিতে বা ছিটিয়ে গম বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপনের জন্য জমি তৈরীর পর লাঙ্গল দিয়ে সরু নালা তৈরী করে ২০ সেমি দূরত্বের সারিতে ৪-৫ সেমি গভীরে বীজ বুনতে হয়। আগাম বপনের জন্য পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে গম আবাদ করা যায়। যন্ত্রটির সুবিধা হলো ধান কাটার পরপর একই সময়ে চাষ, বীজ বপন ও মই দেওয়ার কাজ করা যাবে। যন্ত্রটিতে ২০ কেজি বীজ রাখার মতো একটি হপার থাকে এবং ২০ সেমি. দূরে দূরে ৬ সারিতে ৩-৪ সেমি. গভীরে বীজ বোনা যায়। বীজ বোনার সঙ্গে সঙ্গে বীজ ঢেকে দেয়া হয় করে বলে পাখি কম ক্ষতি করে এবং শতকরা প্রায় ২০ ভাগ বীজের সাশ্রয় হয়।
বেডপ্লান্টারের সাহায্যে বীজ বপন
বেড প্লান্টার, আধুনিক কৃষি যন্ত্র বাঁচাবে শ্রম সময়, যোগাবে অর্থ। বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকার সারা দেশে কৃষি যন্ত্রপাতিতে মোট দামের ৫০% এবং হাওর এলাকার জন্য ৭০% ভর্তুকি প্রদান করছে। সুবিধা হলো বেডে ফসল চাষ করলে সেচ খরচ ও সময় ২৫% কম হয় এবং এক্ষেত্রে শ্রমের সাশ্রয় হয়। এ যন্ত্রের সাহায্যে ঘন্টায় ২৫-২৭ শতাংশ জমিতে বীজ বপন করা যায়।
বৈশিষ্ট্য
১. প্লান্টার হলো সিডারের উন্নত ভার্সন। সিডার যন্ত্রে শুধু সারি থেকে সারির দূরত্ব নির্ধারিত থাকে। কিন্ত বেড প্লান্টার যন্ত্রে সারি থেকে সারির দূরত্বের পাশা-পাশি সারিতে বীজ থেকে বীজের নির্ধারিত দূরত্ব ও বজায় রাখে।
২. যন্ত্রটি দিয়ে গম, ভূট্টা, মুগ, তিলসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি বীজ সফলভাবে বপন করা যায়।
৩. যন্ত্রটি দিয়ে ১-২ চাষে বেড তৈরি, সার প্রয়োগ ও বীজ বপনের কাজ একই সাথে করা যায়।
৪. স্থায়ী বেডে ফসলের অবশিষ্টাংশ রেখে শুন্য চাষে বীজ বপন করা যায়।
সার ব্যবস্থাপনাঃ
সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ইউরিয়া সারের দুই তৃতীয়াংশ এবং সম্পূর্ণ টিএসপি, এমওপি ও জিপসাম শেষ চাষের পূর্বে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকী এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া প্রথম সেচের সময় উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সেচছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সার অর্থাৎ ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও জিপসাম শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। গম চাষে নীচে উল্লেখিত হারে সার ব্যবহার করা প্রয়োজন।
সেচ ব্যবস্থাপনাঃ
মাটির প্রকার ভেদে সাধারণত ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময় (বপনের ১৭-২১ দিন পরে), দ্বিতীয় সেচ গমের শীষ বের হওয়ার সময়। (বপনের ৫৫-৬০ দিন পর) এবং তৃতীয় সেচ দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫-৮০ দিন পর) দিতে হবে।
আগাছা দমন:
গম ক্ষেতে মুথা, দূর্বা, বথুয়া প্রভৃতি আগাছা জন্মাতে পারে। আগাছা সময়মতো নিয়ন্ত্রণ না করলে গম গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ছিটিয়ে বোনা গমের জমিতে বীজ বোনার ১৫/১৬ দিন পর আড়াআড়িভাবে দুবার আঁচড়া দিয়ে অনেক আগাছা তুলে ফেলা যায়। আঁচড়া দেয়ার ফলে মাটি আলগা হওয়ায় চারা গাছের বৃদ্ধিও দ্রুত হয়। আঁচড়া দেয়ার কয়েকদিন পর নিড়ানির সাহায্যে বাকি আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। অন্যদিকে সারিতে বোনা গমের বেলায় প্রথম সেচ দেয়ার আগে আগে নিড়ানির সাহায্যে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়।
পাখি তাড়ানো:
বীজ বপনের পর ১০ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ফসল সংগ্রহঃ
চৈত্র মাসের প্রথম থেকে মধ্য-চৈত্র (মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম) পর্যন্ত কেটে গম সংগ্রহ করতে হয়।
বীজ সংরক্ষণ :
সংরক্ষণের পূর্বে মাড়াইকৃত বীজ পরপর ২-৩ দিন রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগ বা তার নিচে নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে। শুকনা গম দাঁতে চিবানোর সময় ‘কট’ করে শব্দ করে ভেঙে গেলে বুঝতে হবে ওই বীজ সংরক্ষণের উপযুক্ত হয়েছে। সংরক্ষণের পূর্বে ঝেড়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করার পর ১.৭৫-২.৫০ মিমি ছিদ্র বিশিষ্ট চালনি দিয়ে চেলে পুষ্ট বীজ বাছাই করে নিতে হবে। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে বীজের সুস্থতা ও অংকুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকবে।