সরিষা গাছে বিভিন্ন পোকা ও রোগ এর আক্রমন ও তাদের প্রতিকার
সরিষা গাছে পোকার আক্রমণ ও দমন
সরিষাতে বিভিন্ন জাতের পোকার আক্রমণ হতে পারে৷ এসব পোকার মধ্যে প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকা এবং প্রতিকার বা দমনের পদ্ধতি আলোচনা করা হলো৷
১।সরিষার জাব পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা উভয়ই সরিষার পাতা, কাণ্ড, পুষ্পমঞ্জরী ও ফল হতে রস শুষে নেয়৷
আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ফলের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়, পাতা কুঁকড়ে যায়৷
পোকা এক প্রকার রস বের করার ফলে মোল্ড ছত্রাক জন্মে আক্রান্ত স্থান কালো হয়৷
ফল ধারণ অবস্থায় বা তার পূর্বে আক্রমণ হলে প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হওয়ার আশন্কা থাকে৷
প্রতিকার :
অক্টোবরে আগাম সরিষা বপন করলে জাব পোকার আক্রমণ কম হয়৷
প্রতি গাছে ৫০টির বেশি পোকা থাকলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি বা সুমিথিয়ন ৫৭ ইসি স্প্রে করতে হবে৷
২।সরিষার কাটুই পোকা
লক্ষণঃ
১। এ পোকা রাতের বেলা চারা মাটি বরাবর কেটে দেয়। ২। সকাল বেলা চারা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায় ।
ব্যবস্থাপনাঃ
১। সকাল বেলা কেটে ফেলা চারার আশে পাশে মাটি খুড়ে পোকা বের করে মেরে ফেলা । ২। কেরোসিন (২-৩ লি./ হেক্টর হারে) মিশ্রিত পানি সেচ দেয়া। ৩। পাখি বসার জন্য ক্ষেতে ডালপালা পুতে দেয়া। ৪। রাতে ক্ষেতে মাঝে মাঝে আবর্জনা জড়ো করে রাখলে তার নিচে কীড়া এসে জমা হবে, সকালে সেগুলোকে মেরে ফেলা। ৫। ক্ষেতের মাটি আলগা করে দেওয়া। ৬. এ পোকা নিশাচর, রাতের বেলা সক্রিয় থাকে- তাই রাতে হারিকেন বা টর্চ দিয়ে খুজে খুজে পোকা মেরে ফেলা ৭।২০-২৫ মিটার দূরে দূরে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করা। ৮। প্রতি সপ্তাহে ৮০০-১২০০টি ব্রাকন হেবিটর নামক পরজীবি পোকা অবমুক্ত করা। ৯। ক্লোরপাইরিফস গ্রুপের কীটনাশক যেমন: ডারসবান ৫ মিলি./লি হারে অথবা (ক্লোরপাইরিফস+ সাইপারমেথ্রিন) গ্রুপের কীটমাশক যেমন: বাইপোলার ৫০ ইসি বা হাইড্রো বা সেতারা ৫৫ ইসি ২ মি.লি. / লি. হারে অথবা ল্যাম্ডা সাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের কীটমাশক যেমন: ক্যারাটে বা ফাইটার বা রিভা ২.৫ ইসি ১.৫ মি.লি. / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যার পর গাছের গোড়ায় স্প্রে করা।
সাবধানতাঃ
১। এলোপাতারি বালাইনাশক ব্যবহার করে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করবেন না।
করনীয়ঃ
১। উত্তমরুপে জমি চাষ দিয়ে পোকা পাখিদের খাবার সুযোগ করে দিন। ২। চারা লাগানোর/ বপনের পর প্রতিদিন সকালে ক্ষেত পরিদর্শন করুন।
৩। সরিষার ফ্লি বিটল পোকা
লক্ষণঃ
১। পূর্ণ বয়স্ক ও বাচ্চা উভয়ই ক্ষতি করে । ২। পূর্ণ বয়স্করা চারা গাছের বেশি ক্ষতি করে । ৩। এরা পাতা ছোট ছোট ছিদ্র করে খায় । ৪। আক্রান্ত পাতায় অসংখ্য ছিদ্র হয় ।
ব্যবস্থাপনাঃ
১। হাত জাল দ্বারা পোকা সংগ্রহ । ২। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ । ৩। চারা গাছ জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া । ৪। আক্রান্ত গাছে ছাই ছিটানো ৫। ০.৫% ঘনত্বের সাবান পানি অথবা ৫ মিলি তরল সাবান প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা ।
করনীয়ঃ
১। আগাম বীজ বপন করা ২। সুষম সার ব্যবহার করা
৪।সরিষার করাতমাছি পোকা
লক্ষণঃ
১। এ পোকার কীড়া পাতা খেয়ে সরিষার ক্ষতি করে থাকে।
ব্যবস্থাপনাঃ
১। হাত দিয়ে পিশে পোকা মেরে ফেলা ২. পোকাসহ আক্রান্ত ডগা অপসারণ করা। ৩. ম্যালাথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক যেমন: ফাইফানন ৫৭ ইসি ২ মি.লি. / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকেলে স্প্রে করা।
সাবধানতাঃ
১। ১৫ নভেম্বরের পর সরিষা বপন করবেন না
করনীয়ঃ
১। আগাম সরিষা বপন করুন ২। উন্নত জাতের সরিষা বপন করুন।
৫।সরিষার বিছা পোকা
লক্ষণঃ
১। পাতার উল্টো পিঠের সবুজ অংশ খেয়ে পাতাকে সাদা পাতলা পর্দার মত করে ফেলে। ২। এরা সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়ে এবং পুরো পাতা খেয়ে ফসলের ব্যপক ক্ষতি সাধন করে।
ব্যবস্থাপনাঃ
১। পাতায় ডিমের গাদা দেখলে তা তুলে ধ্বংস করতে হবে। ২। ডিম আথবা আক্রমণের প্রথম অবস্থায় কীড়াগুলো যখন পাতায় দলবদ্ধ অবস্থায় থাকে তখন পোকা সমেত পাতাটি তুলে পায়ে মাড়িয়ে বা গর্তে চাপা দিয়ে মারতে হবে। ৩। কার্বারিল গ্রুপের কীটনাশক যেমন: ভিটাব্রিল ৮৫ ডব্লিউপি ৩ গ্রাম বা সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক যেমন: কট ১০ ইসি ১ মিলি বা সিমবুশ ১০ ইসি ০.৫ মিলি./ লি হারে পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। ৪। ভালভাবে পোকা দমন করতে হলে ক্ষেতের আশে পাশে বা অন্য আগাছা থাকলে তা পরিস্কার করে ফেলতে হবে। ৫। বিছা পোকা যাতে এক ক্ষেত হতে অন্য ক্ষেতে ছড়াতে না পারে সে জন্য প্রতিবন্ধক নালা তৈরী করা যায়।
সাবধানতাঃ
১। ক্ষেতের আশ পাশ অপরিচ্ছন্ন রাখবেন না।
করনীয়ঃ
১। নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করে আক্রমণের শুরুতেই ব্যবস্থা নিন।
সরিষার অরোবাংকি রোগ (Orobanchi sp.) সপুষ্পক পরজীবিঘটিত রোগ।
বীজ বপনের ৪৫-৫৫ দিন পরে এ পরজীবী উদ্ভিদের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়।
কা- হলুদ বাদামী বর্ণ ধারণ করে এবং বেগুনী রঙের ফুল দেখা যায়।
সরিষা গাছের শিকড়ের সাথে এ সপুষ্পক উদ্ভিদ সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে।
আক্রান্ত সরিষার গাছ দুর্বল হয়, বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হ্রাস পায়।
ফসল চাষের শস্যাবর্তন পদ্ধতি অনুসরণ করা।
ফুল আসার পূর্বে এ পরজীবি জমি থেকে উঠিয়ে ফেলতে হবে।
বীজ বপনের পূর্বে জমি লাঙ্গল দিয়ে গভীর ভাবে চাষ করা।
রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন-বারি সরিষা ১১, বারি সরিষা ১৬ এর চাষ করা।
সরিষার কান্ড পচা বা হোয়াইট মোল্ড রোগ White Mold Disease of Mustard (Sclerotinia sclerotiorum) ছত্রাকজনিত রোগ
সাধারণত কান্ড ও ফুলে বিশেষ করে বাড়ন্ত ফুল ধরার পর্যায়ে এ রোগ বেশী দেখা যায়।
এটি একটি বীজ ও মাটি বাহিত রোগ। তাছাড়া এ রোগটি বায়ু বাহিত হয়ে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
প্রাথমিক অবস্থায় সরিষা গাছের কান্ডের টিস্যু নরম হয় এবং লম্বা পানি ভেজা দাগ দেখা যায়।
আক্রান্ত অংশের দাগ বড় হয় এবং সাদা তুলার মত মাইসেলিয়াম দেখা যায়।
আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে গাছ শুকিয়ে যায় ও আগাম পরিপক্কতা দেখা যায়।
শুকনো গাছ চিরলে কান্ডের ভিতরে ছোট বড় কালো ছত্রাকের গুটিকা দেখা যায়।
সরিষার বীজ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বপন করে কান্ড পচা রোগ এড়ানো যায়।
প্রোভেক্স ২০০ দ্বারা ২.৫ গ্রাম/ কেজি বীজ হারে শোধন করে বপন করা।
বপনের পরে রোগ দেখা দিলে রোভরাল অথবা ফলিকুর (২.০ গ্রাম/লিটার) পানিতে মিশিয়ে ৩ বার (বৃদ্ধি পর্যায়ে, ফুল আসা ও পড ধরার পর্যায়) প্রয়োগ করলে সরিষার কান্ড পচা রোগ দমন হয়।
সরিষার ডাউনি মিলডিউ রোগ Downy Mildew Disease of Mustard (Peronospora brassicae) ছত্রাকজনিত রোগ
চারা অবস্থার পর থেকে যে কোন সময়ে এ রোগ দেখা যায়।
আক্রান্ত পাতার নিচে সাদা পাউডার দেখা যায়।
আক্রমণ বেশী হলে পাতা ঝলসে ও কুঁচকে যায়, ফলে ফলন কমে যায়।
সুষম সার ব্যবহার করা।
আক্রান্ত ক্ষেতে প্রতি বছর সরিষার চাষ না করা।
ফসল পর্যায়ক্রমে করা।
বীজ বপনের পূর্বে বীজ শোধন (ভিটাভেক্স- ২.৫ গ্রাম বা ২ গ্রাম ব্যাভিষ্টিন প্রতি কেজি বীজ) করা।
রোগের আক্রমণ বেশ হলে ডাইথেন এম ২ গ্রাম, রিডোমেল ২ গ্রাম বা মিলোডি ডুও- ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে করা।
সরিষা পাতা ঝলসানো রোগ Leaf Blight Disease of Mustard (Alternaria brassicae & Alternaria brassicicola) ছত্রাকজনিত রোগ
গাছের নিচের বয়স্ক পাতায় এ রোগ দেখা যায়।
ছত্রাকের আক্রমণে, পাতায় কান্ডে ও ফলে বিভিন্ন আকারের কালচে রঙের দাগ দেখা যায়।
পরবর্তীকালে এ দাগগুলো একত্রিত হয়ে ক্রমেই বড় দাগের সৃষ্টি হয়।
আক্রমণ বেশী হলে পাতাগুলো ঝলসে যায় ফলে ফলন কমে যায়।
রোগমুক্ত বীজ বপন।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাতের ব্যবহার করা।
বীজ বপনের পূর্বে ২ গ্রাম ব্যাভিষ্টিন বা প্রোভেক্স বা ভিটাটেক্স ২.৫ গ্রাম/ এক কেজি বীজ দিয়ে শোধন করা।
১৫ নভেম্বরের মধ্যে বীজ বপন করা।
বপনের ৫০ দিন পর রোভরাল ২.০ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করে এ রোগ সফল ভাবে দমন করা যায়।
আক্রমণ বেশী হলে রোভরাল বা ডাইথেন এম- ৪৫ ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
(তথ্যসূত্রে-কৃষি বাতায়ন ও plant disease clinic BAU)